“… শেখ কামাল এমনিতে আমাদের সঙ্গে যথোচিত সম্মানের সঙ্গেই কথা বলত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে বঙ্গবন্ধুর পুত্র হিসাবে নিজেকে আলাদা করে দেখতে শুরু করেছিল, তা জানতাম না। এক দুর্বিনীত অহংবোধ হয়ত কাজ করছিল। যেখানে তার কাছে প্রত্যাশা শালীন এবং অমায়িক ব্যবহার, সেখানে সে একটা কেউকেটার বেটার মতোই হয়ে গিয়েছিল।
তা না হলে সামান্য ঘটনা থেকে এত বড় দূর্ঘটনা স্টেডিয়ামে ঘটতে পারত না। ‘আবাহনী’র সঙ্গে অন্য একটি টিমের খেলা চলছে। ‘আবাহনী’ জিতবে। এগিয়েও আছে। ইউসুফ ভাই, আমি এবং শেখ কামাল একসঙ্গে বসে বাদাম খাচ্ছি এবং খেলা দেখছি। মধ্যমাঠে ‘আবাহনী’র এক প্লেয়ার ফাউল করল। রেফারি ননী বসাক, পাকিস্তানের খ্যাতনাম্নী নায়িকা শবনমের পিতা, খেলা পরিচালনা করছিলেন। সে আবাহনীর বিপক্ষে ফাউল দিল। কিকও হয়ে গেল। এই ফাউল ধরাটা ঠিক, না বেঠিক বলা যাবে না। কিন্তু খেলার তাতে কোন লাভ-ক্ষতি হল না। কামাল কিন্তু গর্জে উঠল, দেখলেন, বেটা কিভাবে অন্যায় ফাউল দিল?
সন্ধ্যার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে আমরা মিছিল নিয়ে বের হয়েছি। সেদিন আমাদের সাথে ৫০-৬০ জন নেতৃস্থানীয় নেতা-কর্মী ছিল। এদিকে নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থিত পরিষদ জয়ী হতে পারে আর মুজিবপন্থী পরিষদ পরাজিত হতে চলেছে এমন খবর পেয়ে শেখ কামাল ডাকসুর বাক্স ছিনতাই করে। মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমরা দেখি শেখ কামাল বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রযেছে। তার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। তার পায়ের কাছে কয়েকটি ব্যালট বাক্স। শেখ কামালের আশপাশে কয়েকজন বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিছিল নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে আমরা ধারণাও করিনি যে শেখ কামাল ইতিমধ্যে ডাকসুর বাক্স ছিনতাই করে ফেলেছে।
বঙ্গবন্ধু পুত্রের অভিমত! আমরা চুপ করেই রইলাম। খেলা শেষ হল। আমরা বিদায় নেব নেব করছি। ননী বসাক আমাদের দেখে মাঠ থেকে এদিকে উঠে এল। ক্রীড়ামন্ত্রী রয়েছেন, তাদের সভাপতি আমি রযেছি, শেখ কামাল রয়েছে। সে হাসিমুখে সবার সাথে হাত মিলাতে এগিয়ে এল।
কথা নেই, বার্তা নেই শেখ কামাল ননী বসাককে প্রচন্ড এক ঘুসি মেরে ফেলে দিল। তার মুখ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। শেখ কামাল রাগতস্বরে তখন চিৎকার করছে, বেটা সবসময় এমনি করে ‘আবাহনী’র বিরুদ্ধে বাঁশী বাজায়। ওকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।
তার রাগ তখনও কমেনি। আমরা দু’জন হতভম্ব। আমাদের সামনে কামাল এ কী করল ! আমরা মুখ দেখাব কী করে? ননী বসাক বয়স্ক ব্যক্তি, সে তো কোন দোষ করেছে বলে জানি না। দোষ করলে আমাদেরকে বলা যেত। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হল। হাজার লোক ঘটনা স্বচক্ষে দেখল। বঙ্গবন্ধুর পুত্রের কাছে এ ব্যবহার যে কল্পনাও করা যায় না।
কামালকে হাত ধরে টেনে অফিসে নিয়ে এসে বললাম, কামাল তুমি এ কী কাজ করলে? নিজ হাতে রেফারিকে প্রহার করা তোমার সাজে?
কামাল বলতে লাগল, আপনি জানেন না, ও বেটা সবসময় বদমায়েশী করে। ওকে আরও মারা উচিত।
অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করলাম। পাশের ঘরে আহত ননী বসাককে কি বলে সান্ত্বনা দেব ভাষা খুঁজে পেলাম না। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে চলে এলাম। গাড়িতে গম্ভীর ইউসুফ ভাইকে বললাম, বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানানো প্রয়োজন।
তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন না।
বললাম, এ ধরণের হঠকারিতায় বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিই নষ্ট হবে। আমরা তার কর্মী, তার মঙ্গল চাই। না বললে তিনি একসময় বলতেও পারেন, তোরা আমাকে জানাসনি কেন?
ইউসুফ ভাই বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করলেন এবং আমরা তখনই গণভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ঘটনা জানালাম।
বললাম, আপনার পুত্রের পক্ষে এ কাজ একান্তই অনভিপ্রেত।
তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন, আমি সব শুনেছি, ননী বসাককে এভাবে মারা কামালের ঠিক হয়নি। তবে ননী বসাকও ভালো করেনি!
আমরা বুঝতে পারলাম, মাঠ থেকে সরাসরি এখানে এসেও আমরা সংবাদটি সর্বাগ্রে দিতে পারলাম না। তিনি পূর্বেই জেনে গেছেন। হয়ত পুত্রই টেলিফোনে পিতাকে বলেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সেদিন শেখ কামালের পিতা হিসাবেই সমধিক পরিলক্ষন করা গেল।
এই শেখ কামাল এবং তার সঙ্গীরা এক গভীর রাতে মতিঝিল ব্যাংক পাড়ায় পুলিশের গুলি খেয়ে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। কারণ জানি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছেলে গুলি খাবে কেন? এত রাতে কয়েকজন যুবকসহ মতিঝিলে তার কী কাজ? বঙ্গবন্ধুর পুত্রকে কে না চেনে? তাকে গুলি করা সামান্য কথা নয়! ভিতরে কী কথা, কী রহস্য লুকিয়ে আছে জানি না।
হাসপাতালে কামালকে দেখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু, তার স্ত্রী এবং অনেককেই দেখলাম। ভাবী এবং অন্যরা পুলিশকে যাচ্ছেতাই গাল-মন্দ করলেও বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম বিষণ্ণবদনে বসে আছেন। ঘটনার আকস্মিকতায়, না পুত্রের আহতাবস্থা দর্শনে পিতা আজ নীরব এবং বিষাদগ্রস্ত॥”
– শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (মুজিব সরকারের প্রথম চীফ হুইপ) / বলেছি বলছি বলব ॥ [ অনন্যা – সেপ্টেম্বর, ২০০২ । পৃ: ১৭৩–১৭৫ ]
০২.
“… তেহাত্তরের ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে নির্বাচন করে। তাদের প্যানেলে ডাকসুর সহ-সভাপতি প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল-আলম লেনিন এবং সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। পক্ষান্তরে জাসদ-ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জহুর হোসেন। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় ভোট গণনার সময় দেখা গেল, মাহবুব-জহুর পরিষদ বিপুল ভোটে এগিয়ে। তাদের জয় সুনিশ্চিত। হলগুলোতেও অবস্থা একই রকম। রাত আটটার দিকে লেনিন-গামার সমর্থকেরা ভোট গণনার কেন্দ্রগুলোতে হামলা করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে এক হল থেকে অন্য হলে যান। প্রতিপক্ষ দলের ছাত্ররা এবং ভোট গণনার কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যান। এ প্রসঙ্গে ‘মুজিববাদী ছাত্রলীগে’র একজন কর্মীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
“… সন্ধ্যার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে আমরা মিছিল নিয়ে বের হয়েছি। সেদিন আমাদের সাথে ৫০-৬০ জন নেতৃস্থানীয় নেতা-কর্মী ছিল। এদিকে নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থিত পরিষদ জয়ী হতে পারে আর মুজিবপন্থী পরিষদ পরাজিত হতে চলেছে এমন খবর পেয়ে শেখ কামাল ডাকসুর বাক্স ছিনতাই করে। মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় আমরা দেখি শেখ কামাল বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রযেছে। তার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। তার পায়ের কাছে কয়েকটি ব্যালট বাক্স। শেখ কামালের আশপাশে কয়েকজন বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিছিল নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে আমরা ধারণাও করিনি যে শেখ কামাল ইতিমধ্যে ডাকসুর বাক্স ছিনতাই করে ফেলেছে। (ইজাজ আহমেদ বিটু / হতভাগা জনগণ – প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ, রাঢ়বঙ্গ, রাজশাহী)।”
… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেটা ছিল একটা কলঙ্কজনক দিন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন জিতে যাবে, এটা মেনে নেওয়ার মতো উদারতা আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। জাসদ থেকে অভিযোগ করা হয়, সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি কোনো রকমের ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে সরকারে যোগ দেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান॥”
– মহিউদ্দিন আহমদ / জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি ॥ [ প্রথমা প্রকাশন – অক্টোবর, ২০১৪ । পৃ: ১০৫–১০৬ ]
০৩.
৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন: ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
আর্জিতে বলা হয়, ” ……. সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন ……।”
তথ্যসূত্র : ভাসানী মুজিব জিয়া : ১৯৭২–১৯৮১ / জিবলু রহমান ॥ [শুভ প্রকাশন – মে, ২০০৪ । পৃ: ১৮৯]
০৪.
“… আমি (ড:) কামালের বসার ঘরে ঢুকে শেখ সাহেবের পাশেই সোফায় বসলাম। তিনি আগে থেকেই অনেক কথা বলছিলেন। তাঁকে কিছুটা উত্তেজিতও মনে হচ্ছিলো। কালো গাউন পরা উকিলদের বিরুদ্ধে তিনি অনেক কিছু বলছিলেন। কারণ ঐ দিন ঢাকা হাইকোর্টের দেড়শো-দুশো উকিলের এক বিবৃতি শেখ সাহেবের জ্যোষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল কর্তৃক মাহমুদ আলীকে অপহরণ এবং আবাহনী ক্লাবে আটক রাখার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। শেখ কামালের এই অপহরণের বিরুদ্ধে তখন শুধু উকিলরাই নয়, অনেক মহল থেকে জোর প্রতিবাদ ও সমালোচনা হয়েছিল॥”
– বদরুদ্দীন উমর / আমার জীবন (তৃতীয় খন্ড) ॥ [ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ – জুন, ২০০৯ । পৃ: ৫১ ]
০৫.
“… (১৪।০৮।১৯৭৫) উদ্দেশ্যহীনভাবে আমি বলাকা বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওমা কিছু দূর যেতেই দেখি একখানা খোলা জিপে সাঙ্গপাঙ্গসহ শেখ কামাল। একজন দীর্ঘদেহী যুবক কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, দেখ কামাল ভাই, আহমদ ছফা যাচ্ছে। কামাল নির্দেশ দিলেন, হারামজাদাকে ধরে নিয়ে আয়। আমি প্রাণভয়ে দৌড়ে নিউ মার্কেটের ভেতর ঢুকে পড়ি। যদি কোনদিন স্মৃতিকথা লিখতে হয়, এই পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিশদ করে বর্ণনা করব॥”
– ছফামৃত / নুরুল আনোয়ার ॥ [ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি – ফেব্রুয়ারি, ২০১০ । পৃ: ১০০ ]
৬.
“… শেখ মুজিবের বড় ছেলে শেখ কামাল ছিল অত্যন্ত বদ মেজাজী। বাবার মতো সেও বাংলাদেশকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করতো। তার পরিবার বা দলের সমালোচনা বা বিরুদ্ধাচরণকে কামাল রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে মনে করতো। শেখ মুজিব হয়তো তার ছেলের কিছু কিছু কান্ডকীর্তি পছন্দ করতেন না – কিন্তু তবুও তিনি তাকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে বাংলার আকাশে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন॥”
– অ্যান্থনী মাসকারেণহাস / বাংলাদেশ : আ লেগ্যাসি অব ব্লাড ॥ {অনুবাদ : মোহাম্মদ শাহজাহান । হাক্কানী পাবলিশার্স – মার্চ, ২০১২ । পৃ: ৪৩ ]
৭.
… তিনি একদিন জীপ চালিয়ে কলাভবনের প্রধান ফটক পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ ডান দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেন একটি সুন্দরী তরুণী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। রাজকুমারের জীপ থেমে গেল। মেয়েটি কাছে আসতেই তিনি হুকুম দিলেন তাঁকে গাড়িতে উঠতে। হতভাগিনীটি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে শুরু করলে জীপের অন্য আরোহীরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে জীপে তুলে নিল।…
গতকল্য (বৃহস্পতিবার) রাত সাড়ে দশটা, নিস্তব্ধ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। অন্ধকার রাস্তা। সেই নৈ:শব্দ্যকে বিদীর্ণ করিয়া একটি জীপ আসিয়া দাঁড়াইল শাসুন্নাহার হল আর জগন্নাথ হলের মাঝখানে। জীপ হইতে নামানো হইল হাত পিছমোড়া দিয়া বাঁধা মুখ চোখ বাঁধা ৫ টি তরুণকে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাইয়া স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝঁরা করিয়া দেওয়া হইল ৫ টি তরুণ বক্ষ। একবার, দুইবার, কয়েকবার। শিহরিত হল মানবতা। রাত্রি সাড়ে দশটায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৫ টি রক্তাপ্লুত তরুণ আর পৈশাচিক বিভীষিকাকে পিছনে ফেলিয়া জীপটি ফিরিয়া গেল। পেছনে একটি সাদা মাজদা গাড়ী রক্ষক হিসেবে॥
– দৈনিক ইত্তেফাক / ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩
তথ্যসূত্র : কালে–কালান্তরে / ড. সাঈদ–উর রহমান ॥ [ আফসার ব্রাদার্স – জুলাই, ২০০৪ । পৃ: ২২ ]
৮.
“… মোনেম খানের পোলার মতো হইস না। তার আগে আমারে গুলি কইরা মার (কপালে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে)॥”
– ক্ষুব্ধ মুজিব শেখ কামালকে
তথ্যসূত্র: ক্রাচের কর্নেল / শাহাদুজ্জামান ॥ [ মাওলা ব্রাদার্স – ফেব্রুয়ারী, ২০১০ । পৃ: ১৯০ ]
৯.
“… জিপ এগুচ্ছে পুলিশের সতর্কতা উপেক্ষা করে। জিপের ভেতর থেকে বলা হয়: “আমি কামাল”। কতো কামালই তো আছে। সন্দেহ দোষে দুষ্ট জিপ থামাতে পুলিশ চালায় গুলি। মারাত্মক ভাবে আহত হন কামাল। জীবন-মরণ সংশয়ে তখন তিনি হাসপাতালে।
ঘটার যা ততোক্ষণে সবই তো ঘটে গেল। কিন্তু বিপাকে পড়েন ঢাকার তখনকার সিটি এসপি মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমদ। জনগণের নিকট তখন তিনি এসপি মাহবুব নামেই সমধিক খ্যাত। একাত্তরে সাতক্ষীরার সন্নিকটবর্তী রণাঙ্গণ বালিয়াডাঙ্গার যুদ্ধে অত্র লেখক শত্রুর পাউন্ডার শেলে মারাত্মকভাবে আহত হলে এ মাহবুবই তাকে উদ্ধার করার জন্য মৃত্যু-গুহার রণাঙ্গণে প্রবেশ করেন। সে যুদ্ধে তিনিও শত্রুর গুলিতে আহত হন। পরে তাদের দুইজনেরই চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় ব্যারাকপুর সামরিক হাসপাতালে।
ঘটার যা তা ঘটলো কিন্তু রটলো অনেক বেশি। এবার ভয়াবহ এই দু:সংবাদ নিয়ে কে যাবে শেখের বাসায়? কে পৌঁছাবে খবর? প্রশাসনের ঊর্ধতন মহল এসপি মাহবুবকেই বেছে নিলেন সংবাদ বাহক হিসেবে। শেখ-পত্নীর প্রচ্ছন্ন স্নেহাশীষ ছিল মাহবুবের প্রতি। এ-ছাড়া আরও অনেক খবর তখন বাতাসে ভেসে বেড়াতো।
একাত্তরের শৌর্যে-বীর্যে নন্দিত-বন্দিত মুক্তিযোদ্ধা এসপি মাহবুব ইউনিফর্মে সরাসরি শেখ-ভবনে উপস্থিত। সামরিক কায়দায় স্যালুট করে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন শেখ মুজিবের সামনে। বঙ্গবন্ধু তখন দেশের প্রশাসন-প্রধান। মাহবুব তাকেই সরাসরি জানান এই দু:সংবাদ। সিংহ গর্জনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন শেখ মুজিব : ‘কে করেছে গুলি?’ নির্ভীক জবাব এসপি মাহবুবের কন্ঠে : ‘আমি।’ এবার আনত মস্তকে নিজের বেল্ট ও লোডেড পিস্তল খুলে রাখলেন মাহবুব শেখের পদতলে : ‘যা করার আমাকে করুন। কোন রক্ষী নিয়ে আসিনি। কেউ জানবেনা এ খবর। লোডেড পিস্তল আপনার সামনেই রয়েছে।’ পিন পতন নীরবতায় সময় যায়। রোরুদ্যমান শেখ মুজিব এতোক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলে নেন। শেখের কন্ঠে এবার কিঞ্চিত ভিন্ন সুর : ‘তোরা আমাকে ভুল বুঝলি। আমিও বাপ, স্নেহময় পিতা। আমি আমার আহত সন্তানকে দেখতে চাই। ভিন্ন পোষাকে যাব, কেউ চিনবে না আমাকে। এ কথা শুধু জানবি তুই এসপি মাহবুব। আর কেউ না॥”
– (একান্ত সাক্ষাৎকার / এসপি মাহবুবউদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম)
তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গণ : গেরিলাযুদ্ধ ও হেমায়েতবাহিনী / কর্ণেল (অব🙂 মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক ॥ [ আহমদ পাবলিশিং হাউস – মার্চ, ২০০৪ । পৃ: ৩১২–৩১৩ ]
You have copy pasted works from Kaus Kai. This is disgusting intellectual theft when you simply don’t have that level of reading.