ভাসানীর আওয়ামী লীগ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সম্পূর্ণ আধুনিক ও সেক্যুলার সংগঠন ছিলো। স্বরাজ পার্টি, খিলাফত, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠনে অবস্থান করেও ভাসানী মোটের ওপর একজন দলনিরপেক্ষ ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী নেতা ছিলেন। চিরকাল তিনি প্রবলের বিরুদ্ধে এবং অবহেলিত-নিপীড়িত-বঞ্চিতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কোনো দলের অনুপ্রেরণায় নয়, দলীয় কর্মী বা নেতা হিসেবে নয়, জীবনের প্রথমেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে নির্যাতিতের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শোষক-নিপীড়ক প্রবলের বিরুদ্ধে। মাঝে বড়ো বড়ো দলের নেতৃত্ব দিলেও শেষ দিনগুলোতেও কোনো দলের নেতা রূপে নয়, ব্যক্তি হিসেবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন ভাসানী। তাই তাঁর সম্পর্কে ভারতের দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’ যথার্থই লিখেছিলো-Forever the Fighter চিরকালের যোদ্ধা। ষাট বছরের রাজনৈতিক জীবনে মজলুমের পক্ষ অবলম্বন করে তাঁর যে যুদ্ধ বা সংগ্রাম তা কোনোদিন থামেনি-আরাম ছিলো তাঁর জীবনে হারাম। বস্তুত, তাঁর জীবনে বিশ্রাম ও শান্তি আসে তাঁর মৃত্যুর দিন।
কেমন ছিলো মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন, সৈয়দ আবুল মকসুদ
কৃষকের মতই খেয়ে-না-খেয়ে, প্রজা-পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথে জীবন একাকার করে শোষিতের বঞ্চিতের হাহাকার মর্মে মর্মে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯১৯ হতে কংগ্রেস আন্দোলনে, খিলাফত আন্দোলনে, অসহযোগ আন্দোলনে, বেঙ্গল প্যাক্ট আন্দোলনে যোগদান করে, একাধিকবার কারাবরণ করে, মওলানা মোহাম্মদ আলী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করে মোঃ আবদুল হামিদ খান যে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় নিবেদিত ও প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা, ১৯২৪ সন হতে দেখা গেল সেই ধারাবাহিকতার পাশাপাশি তিনি নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করেছেন; আর তা হল –কৃষক আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীর শুরু হতেই তিনি পূর্ব বাংলা ও আসামের গ্রামে-গঞ্জে বলতে গেলে অলিতে গলিতে চষে বেড়িয়েছেন। বিশেষ করে তিনি ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, তিস্তা, গদাধর, গঙ্গাধর, দুধকুমার, মহানন্দা, করতোয়া এমনি শতাধিক নদী বিধৌত এলাকায় আত্মার আত্মীয় খুঁজে বেড়িয়েছেন, নদী-সিকন্তি মানুষগুলোকে ভালোবেসেছেন। তাদের সংগঠিত শক্তিতে জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছাদেরকে উৎখাত করা যাবে –এ বীজমন্ত্র অসহায়দের অন্তরে বদ্ধমূল করেছেন।
শিল্পাচার্যের রঙ তুলিতে মজলুম
এই ছবির জন্ম কাহিনী বর্ণনা করে জনাব জহিরুল হক বলেনঃ পয়গাম কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, মওলানা ভাসানীর ঊননব্বইতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি বিশেষ সংখ্যা বের করার। এই বিশেষ সংখ্যার ছাপার জন্য বার্তা সম্পাদক সৈয়দ আসাদুজ্জামান ও আমি শিল্পাচার্যের কাছে যাই মওলানার একটি ছবির জন্য। সময়টা ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের শেষদিকে।…আমাদের ড্রইংরুমে বসিয়ে বললেন, তোমাদের কথা দিয়েছি মওলানার ছবি এঁকে দিব কিন্তু কী আঁকবো, কীভাবে আঁকবো? আমার মনের মতো করে তাঁকে আমি কিছুতেই ক্যানভাসে আনতে পারছি না। আমি যতবার তাঁর ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছি ততবারই আমার সামনে ভেসে উঠেছে ক্ষুধা, দারিদ্র, শোষণ, গর্কি, জলোচ্ছ্বাস, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিক্ষোভ, সংগ্রাম আর হাহাকার। জহিরুল হক বলেনঃ শিল্পাচার্যকে খুব অস্থির মনে হয়েছিল আমার। তাঁকে মনে হচ্ছিল তিনি যেন একজন মা। একজন মা তার শিশুকে জন্ম দেয়ার জন্য যেভাবে প্রখর যন্ত্রণায় কাৎরায়, ভিতরে জীবন আছে, সে জীবনকে তিনি উপহার দিতে চাচ্ছেন, ভিতরে প্রাণের স্পন্দন তিনি অনুভবও করেছেন, সেজন্য দুর্লঙ্ঘ পথ অতিক্রমের তীব্র আকাঙ্ক্ষাও আছে, কিন্তু কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে সব উদ্যোগ………কথাবার্তার এক ফাঁকে আমি বলেছিলাম, আপনার এই যে ভাবনা তার প্রেক্ষাপটেই আঁকুন না মওলানার ছবি।…আমার এই কথা সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছিলেন তিনি।…বললেন ২/৪ দিন পর এসো। গেলাম অবশেষে ১১ জানুয়ারি, ১৯৭১-এ। আমাদের হাতে তুলে দিলেন তাঁর ‘মওলানা ভাসানী’। ছবির দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ও উত্তেজনায় কাঁপছিলাম আমি। মনে আছে ছবিটিকে গোল করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য। দেয়ার সময় বলেছিলেন ‘ছবিটি তোমাদের দিচ্ছি বটে তবে এঁকে তৃপ্তি পেলাম না। পরিপূর্ণভাবে মওলানা ভাসানীকে আমি ফোটাতে পারলাম না’। এই ছবির জন্য শিল্পাচার্য কোন পারিশ্রমিক নেননি। বর্তমানে ছবিটির মূল কপি আছে সন্তোষে সৈয়দ ইরফানুল বারীর কাছে। অবশ্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ছবিটি ছিল দীর্ঘদিন মাটির নিচে। ফলে একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে এর একটা রিপ্রডাকশন আছে।
জানা অজানা মওলানা ভাসানী; আব্দুল হাই শিকদার
শোষণ-প্রক্রিয়া মওলানা ভাসানী কোন রিপোর্ট কিংবা প্রবন্ধ পড়ে অবহিত হয়েছিলেন, তা নয়। কৃষকের মতই খেয়ে-না-খেয়ে, প্রজা-পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথে জীবন একাকার করে শোষিতের বঞ্চিতের হাহাকার মর্মে মর্মে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯১৯ হতে কংগ্রেস আন্দোলনে, খিলাফত আন্দোলনে, অসহযোগ আন্দোলনে, বেঙ্গল প্যাক্ট আন্দোলনে যোগদান করে, একাধিকবার কারাবরণ করে, মওলানা মোহাম্মদ আলী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করে মোঃ আবদুল হামিদ খান যে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় নিবেদিত ও প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা, ১৯২৪ সন হতে দেখা গেল সেই ধারাবাহিকতার পাশাপাশি তিনি নিজস্ব একটি ধারা সৃষ্টি করেছেন; আর তা হল –কৃষক আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীর শুরু হতেই তিনি পূর্ব বাংলা ও আসামের গ্রামে-গঞ্জে বলতে গেলে অলিতে গলিতে চষে বেড়িয়েছেন। বিশেষ করে তিনি ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, তিস্তা, গদাধর, গঙ্গাধর, দুধকুমার, মহানন্দা, করতোয়া এমনি শতাধিক নদী বিধৌত এলাকায় আত্মার আত্মীয় খুঁজে বেড়িয়েছেন, নদী-সিকন্তি মানুষগুলোকে ভালোবেসেছেন। তাদের সংগঠিত শক্তিতে জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছাদেরকে উৎখাত করা যাবে –এ বীজমন্ত্র অসহায়দের অন্তরে বদ্ধমূল করেছেন। সেজন্যেই ডাক দিতেন কৃষক সম্মেলনের।
নানান মাত্রায় মওলানা ভাসানী বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, সৈয়দ ইরফানুল বারী